১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাশের আগে বাংলাদেশের চারটি স্কুলে পড়তে হয়েছিল আমাকে। শুরুটা হয়েছিল তখনকার মহকুমা শহর মৌলভীবাজারে। ১৯৪৭-এর দেশভাগের ডামাডােলের সময় আমি মৌলভীবাজারের শ্রীনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাস টুয়ের ছাত্র। থ্রি-ফোর পড়েছি মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে ক্লাস ফাইভের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা দিয়ে সােজা বগুড়া জিলা স্কুলে। ক্লাস নাইনের শেষের দিকে হঠাৎই আমার আব্বা বদলি হয়ে গেলেন নােয়াখালী। সেটা ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ২২ বা ২৩ তারিখ দীর্ঘ রেলভ্রমণের পর শরতের এক রােদ ঝলমল দুপুরে আমরা মাইজদী কোর্ট রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে ভূমিষ্ঠ হলাম। স্টেশনে আব্বার অফিসের হেড ক্লার্ক অনুমিয়া সাহেব ভালাে নাম ছিল বােধ হয় আব্দুল ওদুদ) সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। তার সঙ্গে এসেছেন অফিসের আরও কয়েকজন কর্মচারী অদুমিয়া জিলা স্কুলের পশ্চিমে শহরের যে পাকা রাস্তা তার পশ্চিমে দুমিনিট দূরের যে দুকামরার টিনের চাল, তার বেড় ও মাটির মেঝে বিশিষ্ট বাসায় নিয়ে তুললেন আমাদের, সেটা দেখে ছােটবড় সবার মন খারাপ হয়ে গেল। বাসাটি নাকি সদ্যনির্মিত এবং আমরাই প্রথম বাসিন্দা হিসেবে ওটার দ্বারােঘাটন করছি। বাসাটির পেছনে বেশ বড়সড় ধানখেত এবং চারপাশে এখানে সেখানে পানি দিনের বেলাতেই একটা গুইসাপ ছােট্ট সাতাতে উঠানটির ওপর দিয়ে অলস ভঙ্গিতে হেলেদুলে চলে গেল, যেন তাকে তার বিষধর বসরা রেকি করতে পাঠিয়েছে : যা তা দেখে আয়, এই আপদগুলাে কোথেকে জুটল। রাতে শােনা গেল তক্ষকের ডাক।...এই বাসায় বােধ হয় কোনােমতে চোখ কান বুঁজে দিন দশেক ছিলাম আমরা। এরপর কল্যাণ স্কুলের প্রায় দু'শ গজ দক্ষিণে সােনাপুর রােডের ওপর ইউসুফ মিয়া কন্টাক্টরের নতুন বানানাে মুখোমুখি এক জোড়া বাসার দক্ষিণেরটিতে আস্তানা হলাে আমাদের। ওই বাসা থেকে হেঁটে জিলা স্কুলে যেতে দশ বারাে মিনিট লাগত। তবে ওই বাসায় আমার জন্য সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল বাসার পশ্চিমে বেশ বড়সড় একটি বারােযারী কাজলা দিঘি। রােজ সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে ওটাতে কিছুক্ষণ সাঁতার না কাটলে, বিশেষ করে ডুবসাঁতার, মনে হতাে দিনটাই বুঝি বৃথা হয়ে গেল আমার। এমনি মােহনীয় আকর্ষণ ছিল সেই জলাশয়টির।
মাইজদী কোর্ট অর্থাৎ নােয়াখালীতে আমার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল নােয়াখালী জিলা স্কুল।
ওপরে টিনের চাল, পাকা ফ্লোর, ফ্লোরের ওপর চার ফুটের মত পাঁচ ইঞ্চি ইটের দেওয়াল, র ওপরের অংশে পুরােটাই তৰ্জার বেড়ার এল-প্যাটার্নের এই আধাপাকা দালানই ছিল প্রায় দু’শ ছাত্রের মিলনতীর্থ। ওই এল-প্যাটার্নের পূর্ব দিকের অংশের সর্ব দক্ষিণের কামরা ছিল মাননীয় প্রধান শিক্ষকের । ১৯৫৪-এর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমি যখন ক্লাস নাইনে ভর্তি হই তখন জনাব টি, হােসেন ছিলেন প্রধান শিক্ষক। তিনি তখন বদলির আদেশপ্রাপ্ত। তারপর আসেন জনাব মমতাজউদ্দিন আহমদ এমএ,বিটি। তার মতাে অমন স্নেহপ্রবণ, অমায়িক এবং আদর্শ শিক্ষক আমার সারাজীবনে কম পেয়েছি। তিনি ছােটবড় সবাইকে ‘আপনি বলতেন। এমন কি সব ক্লাসে তার ছাত্রদেরও। আর কেউ কখনাে তাকে আগে সালাম দিতে পারত না। ৫৬ সালে আমাদের ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগে তিনি রােজ দুপুরে ইংরেজির কোচিং ক্লাস নিতেন। তার জন্য আমাদের কোনাে ফি দিতে হতাে না। সহকারী প্রধান শিক্ষক সিরাজুল হক মােল্লা সাহেব ও নরুল হুদা বিএসসি স্যারও কোচিং ক্লাস নিতেন। হেড স্যারের সঙ্গে আমার আব্বার (আলহাজ্ব মরহুম এরশাদ আলী বিএ বিটি, নোয়াখালীর তৎকালীন জেলা স্কুল ইন্সপেক্টর) ভালাে বন্ধুত্ব ছিল।
প্রায়ই সন্ধ্যায় একজন আরেকজনের বাসায় সৌজন্য সাক্ষাত করতে যেতেন। এই প্রসঙ্গে ৬৬ বছর আগে জিলা স্কুলে ওই সময় যারা আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ছিলেন, যাদের স্মৃতি আমার হৃদয়পটে চির জাগরূক, তাদের নাম উল্লেখ ও তাদের উদ্দেশে অন্তরের অন্তস্তল থেকে গভীর শ্রদ্ধা ও সালাম জানাতে চাই। আল্লাহপাক তাদের সকলকে অনন্ত শান্তিদান করুন। তারা হলেন সর্বজনাব : মমতাজ উদ্দিন আহমদ, প্রধানশিক্ষক, সিরাজুল হক মােল্লা, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও অল্পবিশারদ, সে আমলে অঙ্কের বইও লিখেছিলেন, মনসুর আহমদ এমএ. (ইংরেজি পড়াতেন। ক্লাস টেনে ছিলেন আমাদের ক্লাস টিচার), শামসুদ্দিন আহমদ (বাংলার শিক্ষক), শামসুল হুদা (স্কুলের খেলাধুলা, স্কাউটিং, জুনিয়র ক্যাডেট রেডক্রস ইত্যাদির দায়িত্বপ্রাপ্ত, অঙ্কের ক্লাসও নিতেন), ক্ষিতীশ বাবু (সংস্কৃতের পণ্ডিত স্যার, বাংলা ব্যাকরণ কী সুন্দর করে যে পড়াতেন), যশােদা বাবু (অকালে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ায় কথা বলতে কষ্ট হতাে তঁার), আনােয়ার উল্লাহ (মূলত ড্রয়িং শিক্ষক, ক্লাস নাইন-টেনে আমাদের ভূগােল পড়াতেন। তার পােশাক-পরিচ্ছদে দারিদ্রের ছাপ ছিল প্রকট।), মুহাম্মদ নূরুল হুদা বিএসসি, নূর মােহাম্মাদ (বাংলা), মৌলভী দলিল উদ্দিন (আরবি) মৌলভী আমিনউল্লাহ (আরবি, আমাদের সহপাঠী আব্দুল গফুরের পিতা), মৌলভী সাদিকউল্লাহ (উর্দু) ও আফসার উদ্দিন (ইতিহাস)। আমার মনে হয়, স্মৃতি থেকে সবার নামই উদ্ধার করতে পেরেছি। এঁদের মধ্যে দুএকজনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। যেমন বিজ্ঞানশিক্ষক জনাব মুহাম্মদ নূরুল হুদা বিএসসি।
উত্তরবঙ্গের জয়পুরহাটের অধিবাসী সৌম্যদর্শন জনাব হুদার কাছে আমি মাস তিনেক প্রাইভেট পড়েছিলাম। আমি সেই শৈশব থেকে অঙ্কাতঙ্কের রােগী ছিলাম! সব বিষয়ে একশ তে ৭০/৮০ পেলেও অঙ্কে ৩০ পেতেই আমার জান বের হয়ে যেত। বগুড়া জিলা স্কুলে পড়ার সময় ক্লাস এইটে প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক আমাকে কিছুদিন প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন। বিনােদবাবু না কি যেন নাম ছিল সেই অতিশয় খর্বাকৃতি, স্বল্পভাষী, বিনয়ী শিক্ষক মহােদয়ের। তিনিই প্রথম আমার অঙ্কাতঙ্ক রােগ। সঠিকভাবে নির্ণয় করে আমাকে রীতিমতাে অঙ্ক প্রেমিক করে তােলেন। তবে নাইনে ওঠার কিছুদিন পর বগুড়া ছেড়ে চলে আসায় সেই চিকিৎসায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। আমার কপাল ভালাে, নােয়াখালীতে নূরুল হুদা স্যারকে পেয়ে যাই। তিনি খুব সুন্দর করে অঙ্ক বােঝাতে পারতেন। তার বাসস্থান ছিল আমাদের বাসার ঠিক পেছনেই শিক্ষক মহােদয়দের একটি মেসে। ওখানে জনাব নূর মােহাম্মদও থাকতেন সপুত্র। আমি রােজ সকালে ওখানে গিয়ে হানা দিতাম। হুদা স্যারের ঘরে চেয়ার-টেবিলের বালাই ছিল না। স্যারের বিছানার ওপর বসে বসেই আমি অঙ্কের জুজু তাড়ানাের মন্ত্র শিখতে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার মাস দুয়েক আগে ওইখানেই সাদিকুল্লাহ হুজুরের কাছে উর্দুর একটা শর্ট কোর্স করি আমি ও বন্ধু হুমায়ুন কবীর চৌধুরী। স্যারের শর্ত ছিল, তােরা আমার কাছে ১০ দিন পড়বি আর ১০ টাকা দিবি। আমি তােদের উর্দুতে লেটার মার্কস (১০০ তাে ৮০) পাইয়ে দেব। স্যার আমাদের উর্দুর মােজাকার (পুংলিঙ্গ)-মুয়ান্নাস (স্ত্রীলিঙ্গ), এক বচন-বহু বচন ইত্যাদিসহ জরুরি বিষয় গুলাে খুব যত্নসহকারে শিখিয়ে দিলেন। তিনি কখনাে কখনাে সুর করে কোনাে হিন্দি গানের একটি কলি ভেজে বলতেন, দেখলি, এখানে তু গঙ্গা কি মৌজ, ম্যায় যমুনা কা ধারা...' বলেছে, কা মৌজ বলেনি। তা হলে মৌজ (তরঙ্গ) কী হলাে? মুয়ান্নাস (স্ত্রীলিঙ্গ)। ঠিক আছে?” আমি উর্দুতে এমনিতেই খুব ভালাে ছিলাম। স্যারের দশদিনের কোচিংয়ে আরও শিওর হয়ে গেলাম নিশ্চয়ই লেটার মার্কস পাব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা হয়নি। বােধ হয় কোনাে কঞ্জুস কিংবা নার্ভাস পরীক্ষকের হাতে খাতা পড়েছিল। তিনি আমাকে ১০০ তে ৭৮ দিয়েছিলেন।
সেবার (১৯৫৬) নোয়াখালী জিলা স্কুলের কেউ কোনাে বিষয়ে লেটার মার্কস পায়নি। এমন কি অংকে পারদর্শিতার জন্য যার উপাধি ছিল যাদব বাবু (সেকালের প্রখ্যাত অঙ্কশাস্ত্রবিদ)। সেই শামসুল হক (2)ও না। আরেকটি বিষয়েও আমি অল্পের জন্য লেটার "মিস করি। সেটি ভূগােল। আমি পেয়েছিলাম ৭৪। আমি ক্লাস নাইনের শেষভাগে নােয়াখালী জিলা স্কুলে এসে দেখলাম ক্লাসের ফা্স্টবয় মাওলানা আমিনুল ইসলাম। হ্যা, মাওলানা। আমিনুল মাদ্রাসায় আলিম পাশ করে এসে স্কুলে ভর্তি হয়। সবাই তাকে তাই মাওলানা ডাকত। বয়সে সে আর সকলের চেয়ে অনেক বড় ছিল। মাওলানা হলেও তার দাড়ি ছিল না, রােজ দাড়ি কামাতাে সে। আর আমাদের সবার তখন দাড়ি-গোফ উঠি উঠি করছে। এমনিতে সে খুব হাসিখুশি ও ভদ্র ছিল। নাইনের বার্ষিক পরীক্ষায় তাকে ডিঙ্গিয়ে আমি ফার্ট্ট হয়ে গেলাম। টেনের সব পরীক্ষাতেও আমি ফাস্ট আর ও সেকেন্ড হতাে।
তবে মাওলানাকে নিয়ে সবচেয়ে মজার স্মৃতি হচ্ছে ১৯৫৫ সালের প্রাদেশিক স্কাউট র্যালি। ওটা হয়েছিল ঢাকার শাহবাগে। এখন যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সেখানটা ও তার আশপাশের সব জায়গা ছিল বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঝখানে একটা বিরাট পুকুর। ওখানে হয়েছিল স্কাউট র্যালি। আমি তাে আবার ক্লাস থ্রি-ফোর থেকে কাব, স্কাউট, জুনিয়র ক্যাডেট ইত্যাদির সক্রিয় সদস্য ছিলাম। সেবার আমাদের জিলা স্কুলের স্কাউট দল ঢাকা গেল র্যালিতে অংশগ্রহণ করতে। ওটাই ছিল আমার প্রথম ঢাকা দর্শন। ওখানে রাতের ক্যাম্প ফায়ারে আগুনের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে আমরা ছ'সাতজন খরবায়ু বয় বেগে চারিদিকে ছায়া মেঘে গানটি গেয়েছিলাম। আমিনুল মাওলানাও ছিল সেই নৃত্যগীতের দলে। ওকে দেখেই বেরসিক দর্শকদের সারি থকে ‘এই দেবদার বাপ, দেবদার বাপ ধ্বনি উঠল। একে তাে আগুনের আঁচে আমরা কাবু হয়ে আছি, তার ওপর এমন "অপমান নষ্ট করা টিটিকারি। মাওলানা নাচের মুদ্রা বাদ দিয়ে নাচতে নাচতে মুঠি পাকিয়ে দুয়াে দেওয়া দুষ্ট ছেলেদের শাসাতে লাগল। তখন সে কী হাসির রােল। ক্যাম্পের শেষদিন রাতে হঠাৎ শুরু হয় কালবৈশাখী। সেই প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে সবগুলাে তাঁবু লণ্ডভন্ড হয়ে গেল। ওই বিপদের সময় মাওলানা জোরে জোরে আজান দিতে লাগল। সেই সঙ্গে আমাদের সবাইকে পবিত্র কুরআন শরীফের একটি আয়াত আওড়াতে বলল: ফীহা বাতশতুম বাতাশ তুম জানিনা। আমরা ওর নির্দেশ মানলাম। বহকাল পর আবিষ্কার করলাম, ওই আয়াতটি ঠিক প্রাসঙ্গিক ছিল না। ওই রাতে আমরা বৃষ্টিতে ভেজা বিছানা-বালিশ, কাপড়-চোপড় নিয়ে গিয়ে উঠলাম অনতিদূরের নির্মীয়মাণ আর্ট কলেজ ভবনে। সেখানে জেগে
জেগে কাটল সেই দুর্যোগপূর্ণ রাত। ১৯৫৫ সালে আমাদের জুনিয়র ক্যাডেট দল কুমিল্লার ময়নামতি হাই স্কুলে গিয়েছিল সাতদিনের ক্যাম্পিংয়ে। আর কেউ না. শুধু
আমরা আমরাই। খুব মজা হয়েছিল সেবার। ক্লাস টেনে পড়ার সময় আমাকে গল্প-কবিতা লেখার বাতিকে পেয়ে বসল। তখন খুবই উন্নত মানের শিশু-কিশাের পত্রিকা ছিল আলাপনী। ওটাতে আমার সহপাঠী সুদর্শন গুণী বন্ধু হুমায়ুন কবীর চৌধুরী (পরে হুমায়ুন চৌধুরী নামে গল্প লিখে খুব নাম করেছিল হুমায়ূন। তার হাতের লেখা ছিল মুক্তার মতাে, ছবিও আঁকত খুব সুন্দর। ২০১৩ সালে ও আমেরিকায় মেয়ের বাসায় হঠাৎ মারা যায়।) একবার একটা ছোট গল্প, নাম সমগােত্র', লিখে ক্লাসে রীতিমত হৈ-চ বাধিয়ে দেয়। কাদিন পর আমারও একটা গল্প ছাপা হয় আলাপনীতে। নাম ক্রিটিক'। গল্পটা বােধ হয় ভালােই হয়েছে। ওটা নিয়েও মাতামাতি করল সহপাঠী বন্ধুরা। আর হুমায়ুন ও আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেন শামসুল হক (পরবর্তী কালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক। বেশ কিছুদিন আগে সেও অকালে চলে গেছে দুনিয়া ছেড়ে। ও হুমায়ুনদের তহুরা মঞ্জিল’ বাসায় লজিং থাকত। আমরা তাই তাকে ডাকতাম মাস্টরিয়া।) ক্রিটিক নামটিকে ব্যঙ্গ করে ছড়া কাটতে লাগল : ক্রিটিক দেখে বেঠিক নাচে! লেখক মশাই দাড়ি চাছে...। ইত্যাদি।
আমি কি বসে থাকতে পারি। আমিও মুখে মুখে সমগােত্র শব্দ নিয়ে ছড়া বানিয়ে ক্লাস মাতালাম। আসলে ক্লাসে বসে আমি যতটা না স্যারদের মূল্যবান বক্তব্য শুনতাম তার চেয়ে বেশি মনােযােগ সহকারে ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে স্কুল সংলগ্ন দক্ষিণের জলাভূমিতে খেয়া নৌকাগুলোর আনাগােনা, উত্তরের জামে মসজিদের পুকুরে লােকজনের স্নানপর্ব, সাঁতার কাটা দেখা, আর না হয় চুপচাপ বসে বসে ছড়া-কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম। আমার আরেকটি আকর্ষণ ছিল টিফিন পিরিয়ডে কমনরুমে ক্যারাম ও টেবিল টেনিস খেলা। তখন আমাদের কী টিফিন খেতে দেওয়া হতাে শুনবেন? প্রায় রােজই হয় একটা গােল মতাে কেক, না হয় দু’চার পিস বিস্কুট, সঙ্গে একটা কলা। একটা গােলাকৃতি টিনের বাক্সে করে ফোর্থ পিরিয়ডের শুরুতেই পিয়ন শামু ভাই টিফিন গছিয়ে। দিয়ে যেতেন ক্লাস ক্যাপ্টেনকে। আরেকজন পিয়ন ছিলেন পূর্ণদা। তিনি বাধ হয় স্যারদের ফুটফরমাশ নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন। আমাদের স্কুলের কেরানি সাহেব ছিলেন মােহাম্মদ উল্লাহ। বয়স আনুমানিক তিরিশ। ওই বয়সেই মুখে একমুখ দাড়ি। আমাদের ম্যাটিক ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর একদিন তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন টাইপিং শিখে নিতে। শুনে আমি মনে মনে বেশ বিরক্ত হলাম। বলে কী। আমি কি কেরানি হব নাকি। বহুকাল পর সত্তরের দশকে মেলবাের্নের মনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স অব অ্যাডমিনিদ্টৌশন পড়তে যখন নিজ হাতে এক আঙ্গুলে টাইপ করে অ্যাসাইনমেন্ট পরামর্শটি তখন গ্রহণ করতাম। জমা দিতে হতাে তখন আফসােস হতো, ইস, যদি মােহাম্মদ উল্লাহ স্যারের পরামর্শ গ্রহন করতাম।
। টিফিন পিরিয়ডের ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বড় হুজুর দলিল উদ্দিন সাহেব ক্লাস টেনের কামরার সংলগ্ন বারান্দার প্রবেশপথে উজি ল না। সেখানে আমি আর হুমায়ুন থাকতেন ছাত্রদের মসজিদে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তার সামনে পড়ে গেলে মসজিদে না গিয়ে উপায় ছিল না। সেখানে আমি আর চৌধুরী পাশাপাশি দাঁড়াতাম, আর সেজদায় গিয়ে ফিসফিস করে কথা বলতাম। (আল্লাহ মাপ করে)। আমাদের ক্লাসের অন্যতম আকর্ষণ ছিল লইয়ার্স কলােনির হুমায়ুন। লেখাপড়ায় তেমন সুবিধা না করতে পারলেও ক্লাস শুরুর আগে রাে সে টেবিল চাপড়িয়ে গলা ছেড়ে গান গাইত। বেশির ভাগই হিন্দি সিনেমার গান। ও একটু পাগলাটে টাইপের ছিল। তবে মানুষটা ছিল সহ সরল।
ওই সময় স্কুলে ভাল গান গাইত আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়ুয়া আমিনুর রহমান শানু, সহপাঠী আবুল কালাম আযাদ, মাহবুবুল আলম (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রদূত) ও আরও কয়েকজন। একবার স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মাহবুব গাইল শান্ত নদীটি, পটে অাঁকা ছবিটি” গানটি। সঙ্গে স্টেজে রাখা দুটো ব্ল্যাকবাের্ডে স্কুলের দুই নামকরা আঁকিয়ে হুমায়ুন চৌধুরী ও আমাদের আরেক সহপাঠী গােলাম রব্বানি গান শুনে শুনে রঙিন চক দিয়ে ছবি আঁকল। ওটা ছিল একটা প্রতিযােগিতা, আমরা নিশ্চিত ছিলাম হুমায়ুন জিতবে, কারণ তার ছবি আঁকার হাত সত্যি ছিল অপূর্ব। কিন্তু সবাইকে অবাক করে বিচারকদের রায়ে রব্বানি জিতে গেল। আমাদের অনেকেরই তাতে মন খারাপ হলাে। সেদিন কেন জানি হুমায়ুন ভালাে আঁকতে পারেনি। ওই অনুষ্ঠানটি খুবই সুন্দর হয়েছিল। গান কবিতা হাস্যকৌতুক ইত্যাদির সঙ্গে ছিল "টিপু সুলতান’ নাটকের মঞ্চায়ন। আমাদের ক্লাসের আব্দুল ওয়াসে খুব ভালাে নাটক করত। সে হয়েছিল টিপু সুলতান, আমাদের এক বছরের জুনিয়র সারওয়ার হায়দার আলী ও আমি নানা ফড়নবিশ। নােয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় রচিত একাঙ্কিকাটি সবাইকে খুব আনন্দ দিয়েছিল। ভালাে কথা। আমার সংগীতচর্চার অকালমৃত্যু কিন্তু ঘটেছিল ওই নােয়াখালী জিলা স্কুলেই।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার ৩-৪ দিনের মাথায় রফিক স্যার নামক একজন শিক্ষকের ফেয়ারওয়েল সভা। সহপাঠীরা ধরল আমাকে ওই সভায় গান গাইতে হবে। আসলে ওরা দেখেছে আমিও পাগলা হুমাইন্যার মত মাঝে মাঝেই গুনগুণ করি ক্লাসে। গাইলাম। ওটা ছিল আমার প্রিয় একটা উর্দু গজল। আমার বড় ভাই (ডা.) তফজুল করিম বগুড়া জিলা স্কুলের সেরা গায়কদের একজন ছিলেন। তার গলায় গানটি শুনে আমিও নিজে নিজে গাওয়ার সুযােগ খুঁজছিলাম। গজলটির প্রথম লাইন ছিল : ‘উয়াে হাওয়া না রাহি, উয়াে চমন না রাহা, উয়াে গলি না রাহি, উয়াে হাসি না রাহি’। মৌলা আলী বলে তাে গান শুরু করলাম, অমনি চতুর্দিক থেকে হা হা, হি হি, ‘আল্লার ওয়াস্তে এবার ক্ষ্যামা দেন’ জাতীয় ধ্বনি। আমার তখন কানটান লাল।
৫৬ সালে মার্চ না এপ্রিলে জানি আমাদের ম্যাট্রিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের সিট পড়েছিল সরকারি উমা গার্লস স্কুলে। আমার রােল নম্বর ছিল নােয়া-১। স্যারদের মতে রােল নম্বরের জন্য হয়তাে আমাকে খেসারতও দিতে হয়। কারণ প্রত্যেক বিষয়ের পরীক্ষার খাতার বাণ্ডিলের প্রথম খাতাটি ছিল ১ রােল নম্বরধারীর। পরীক্ষকরা নাকি প্রথম খাতাটি দেখে থাকেন অতিরিক্ত সতর্কতার সঙ্গে। অন্যান্য পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্রের সঙ্গে তুলনা করারও সুযােগ থাকে না। পাছে ওভারমার্কিং হয়ে যায় সেজন্য নম্বর দেন নিক্তির ওজনে। উর্দু (৭৮), ভূগােল (৭৪), ইতিহাস (৫৭), ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের (৫১) নম্বর দেখে কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না আমি। যা হােক শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার ফল বের হলাে। আমাদের স্কুল থেকে আমরা ৩০ জন পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ৫ জন পেলাম প্রথম বিভাগ, ২০ জন দ্বিতীয় বিভাগ ও ৫ জন তৃতীয় বিভাগ। সেটা ছিল বােধ হয় জুন মাস।
আর ঠিক ওই সময়েই আব্বার বদলির আদেশও এল। এবার গন্তব্যস্থল রাঙ্গামাটি। একদিন রাতের ট্রেনে আমরা রওনা দিলাম চট্টগ্রামের উদ্দেশে, যাব রাঙ্গামাটি। পেছনে পড়ে রইল আমার এত ভালাে লাগার জিলা স্কুল, গ্রাম-গ্রাম শহর মাইজদী কোর্ট এবং প্রাণের বন্ধুরা, যাদের নাম নােয়াখালীর আঞ্চলিক উচ্চারণে উচ্চারিত হতাে এভাবে : মােশারইপ্যা, হুমাইন্যা, শামসুল হইক্যা, খইল্যা, নূরুল হইক্যা, বাশারিয়া, আহমইয়া ইত্যাদি। আর আমি হয়ে গিয়েছিলাম মােফাজ্জইল্যা। ক্ষতি নেই। তবু তাই তারা আমাকে হৃদয়ে স্থান দিয়েছিল। তবু তাে আমি তাদের ভালােবাসায় সিক্ত হতে পেরেছিলাম। আজ দুনিয়াতে ওই ব্যাচের মাত্র ছয় জনের সন্ধান পেয়েছি যারা আমার মত বিমানবন্দরের ডিপারচার লাউঞ্জে বসে প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে, কখন ডাক আসবে। তারা হলাে : জাহাঙ্গীর, মােশাররফ, নুরুল হক, আনােয়ারুল করিম, অ্যাডভােকেট খলিলুর রহমান ও আবুল বাশার। যারা পরপারে চলে গেছে। আল্লাহপাক তাদের জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন। জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন আমার পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের। আমিন। বেঁচে থাকো প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান নোয়াখালী জিলা স্কুল, চির আয়ুষ্মান হও।
১৯৫৪ (সেপ্টেম্বর) - ১৯৫৬ সালে নোয়াখালী জিলা স্কুলে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় সতীর্থ আহমদ করিমের মুখে শােনা পুঁথি-গানের শুরুটা ছিল এরকম :
" ছমুনির উত্তরেদি গেছে এক খাল
হেই খালেদি ভাসি আইল আশি মইন্যা তাল
আশি মইন্যা তাল ভাই রে নব্বই মইন্যা দানা
লাচ্চাইতে লাচ্চাইতে নিল বেঅমগঞ্জ থানা
বেঅমগঞ্জ থানা নরে আইট্যা চুরির হুল
সরকার দাদা হুতি রইছে খনতা মারি তুল
সাধের কলমিলতা, সা-ধের কলমিলতা
যাইমা কোতা হানি হুয়াইলে,...
- এএইচ মোফাজ্জল করিম, ( সাবেক সচিব ও হাইকমিশনার (ইউকে, আয়ারল্যান্ড)
#ব্যাচ_১৯৫৬
নোয়াখালী জিলা স্কুল